4 yrs - Translate

ঘড়ির কাটা বারোটা বাজতে চলেছে। থামানোর কেউ নাই, চলতেই আছে। একটু পর খ্রিষ্টাব্দ ক্যালেন্ডারের একটি তারিখ চিরদিনের জন্য খতম হয়ে যাবে। আমি ক্যালেন্ডারের নতুন তারিখের মতো হাজির হলাম। পকেট থেকে অনেক চাবি ঠেলে ফ্লাটের চাবিটা বের করলাম।

বিয়ের আগের জীবনে একটা আর্তি ছিল, ভালোবাসা পাই না-পাই, অন্তত কেউ যেন ঘরের ভেতর থেকে দরজাটা খুলে দেয়। অথচ এখন কলিংবেলে চাপ দিতেও ভয় পাচ্ছি। কথা শুনতে তেমন ডরভয় নাই, ভয়টা মূলত একজন মানুষের নিষ্পাপ ঘুমে বিঘ্ন সৃষ্টি করার। এ অপরাধবোধটা আমার অবিবাহিত জীবনের আদিখ্যেতাসুলভ ঘরের ভেতর থেকে দরজার খোলার কাঙ্ক্ষিত চাওয়া থেকে আমাকে নিবৃত রেখেছে। তাই দেরি করে বাড়ি ফেরা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, তার সাথে নিজের দরজা বাহির থেকে আমাকেই খুলতে হয় প্রতিদিন। এ নিয়ে কিছুটা খেদও আছে।

দরজাটা খুলে দেখলাম ভেতরে নিশুতি অন্ধকার। ডিম লাইটের হালকা নীল আলোর ভিড়ে মশার কয়েলপোড়া ধোঁয়া এক আড়ম্বরি পরিবেশের জন্ম দিয়েছে। খাটে শুয়ে আছেন উনি, মানে উনিই। বুঝা যাচ্ছে না ঘুমিয়েছে কিনা। তাই বুঝার জন্য মুখটা তার মুখের কাছে নিতেই সে বেজে উঠল- এত রাতে পৃথিবীর কোনো স্বামী ঘরে ফেরে?

আমি চুপ করে রইলাম। ভাবলাম, ফেনীর দাগনভূঞায় স্ত্রী স্বামীকে কুপিয়েছে দেরি করে বাড়ি ফেরার কারণে। আমাকেও কোপাতে পারে, এমন শঙ্কা থেকে চুপ করে আছি, তা নয়। থেকে থেকে ভেবেছি তার জবাব ওই কোপানোর মধ্যেই নিহিত। একটি শোকান্তিক ঘটনা আজ আমার দেরি করে আসার প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিষয়টি ভিকটিমের পরিবারের কাছে কেমন লাগবে, সেটাই ভাবছি এখন।

সে এখনো শুয়েই আছে। আমার নিরবতা তাকেও অসার করে তুলেছে। মনে হয়, কিছু না বলে তাকে আজ ভাঙানো যাবে না। সে শক্ত নিথর হয়ে আছে।

বললাম, আমিই একমাত্র স্বামী যে এত রাতে ঘরে ফেরে, এটা হয়ত আংশিক সত্য। তবে গরিষ্ঠহারে স্বামীরা দেরি করে ঘরে ফেরে, জরিপ চালালে এমন তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে, জানা নাই। কথাটা বললাম, যাতে সে তার মতাদর্শে আরো অনড় হয়। এবং হলোও তাই। সে কণ্ঠ থেকে ঘুমের সমস্ত ক্লান্তি কাটিয়ে অনেকটা ঝগড়াটে মেজাজে বলে উঠল, হ্যাঁ, একমাত্র তুমিই আছো! আর কেউ নাই, যে এত রাত করে বাড়ি ফেরে!

স্ত্রীমানসিকতাই হয়ত এমন। স্বামীর খারাপ গুণগুলোর স্বত্ত্ব শুধু তার স্বামীরই। আর ভালো গুণগুলো যেন উন্মুক্ত স্বত্ত্বাধিকার, যেন সব স্বামীরাই তা করে। একেবারে ইউনিক ভালো কিছু করলেও সেটার জরিপ স্ত্রীর কাছে দেখা যাবে, একেবারেই কমন। অমুক করে তমুক করে। এই তথ্যগুলো অবশ্য শুধু স্বামীর কাছেই প্রকাশ পায়। অন্য কোথাও বলতে গেলে আবার স্বামীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ দেখা যায় এই স্ত্রীদেরই। কী আশ্চর্য এক সম্পর্ক!

যাই হোক, আমি দেখলাম সে আর শোয়া থেকে উঠবে না। তাই একপ্রকার জোর করেই আমার একহাত তার গ্রীবা দিয়ে, আরেকহাত তার হাটুর পেট দিয়ে উটকলের মতো তাকে টেনে তুললাম। একেবারে আমার বুকসমান উঁচুতে। আর ভেতরে ভেতরে নিজের শারীরিক অক্ষমতাকে ঢাকতে বললাম, তুমি অনেক ভারী হয়ে গেছ। সে একগাল হাসি ছড়িয়ে তার হাত দুটি আমার গলায় সাপের মতো পেঁচিয়ে ঝুলে থাকলো শরীরে।

বললাম, এত রাত করে কোনো স্বামী স্ত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে এভাবে কখনো কোলে তুলে নেয়?

প্রশ্নটা শুনেই সে কী বিদ্রূপের হাসি! পরিচিত হাসি, আমাকে ঘায়েলকরা হাসি। বলল, কতজন আছে, তুমি একাই নাকি শুধু?

ব্যাস কাঙ্ক্ষিত সুযোগটা পেয়ে গেলাম। বীরের মতো হেসে বলে উঠলাম, তাহলে তো ঠিকই আছে। আমার এত রাত করে ঘরে ফেরাটা তো কমনই হলো, সবাই করে। আমি আর তেমন কী অপরাধী! এই বলে আমি হাতের বাঁধন ছেড়ে দিলাম। হাসতে হাসতে সে-ও শরীর থেকে আলগা হয়ে গেলো।

এরপর সে পরাজিতের সুখদ লজ্জার হাসি দিয়ে বলে, যাও ফ্রেশ হয়ে আসো, খাবার দিচ্ছি।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। দেখলাম ঘড়ির কাটা টিক টিক করে বারোটা বাজতে চলেছে, তাকে থামানোর কেউ নাই...